জনগণ হিসেবে আমরা মোটেই আমাদের কর্তব্য পালন করছি না! একটার পর একটা ভুল করে ভুলের পাহাড়ে বসে টেনশন করছি আর কার্ডিওলজিস্টদের ইনকাম বাড়াচ্ছি। দেশের স্বার্থের কথা ভেবে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু কর্মকাণ্ডে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। মুহুর্মুহু হরতালে হু-হু করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। অথচ এই কোরাস কান্নাসংগীতে কারও কিছুই আসে-যায় না; বরং এ সংগীতের মূর্ছনায় আমরা নিজেরাই মূর্ছা যাচ্ছি। যানজটকে আমরা যেমন আপন করে নিয়েছি, তেমনি হরতালকেও যদি জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে স্বীকার করে নিতাম, তবে কতই না মধুর হতো! তখন দেশমাতার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা আতঙ্কিত হতাম না, রুজির চিন্তায় শরীরটাও কাবু হতো না!আসুন না, নিজেদের মানসিক শান্তির জন্য হরতালকে ‘ক্ষতিকর’ না ভেবে ‘হিতকর’ ভাবি! লাগাতার বৃষ্টির দিনে একপশলা ঘুম কদুর তেলের মতো মাথা ঠান্ডা করে দেয়। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশ-খিচুড়ি অমৃতের মতো লাগে। হরতাল ছাড়া এসব আনন্দ উপভোগের অবসর কোথায়? এখন কাজের চাপে ফ্যামিলিকে সময় দেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দফায় দফায় বা লাগাতার হরতাল হলেই কেবল সুযোগ মেলে!অনেক নিন্দুক বলেন যে হরতাল দেশের অর্থনীতির চাকা অচল করে দেয়! কিন্তু একবারও কি হরতালময় অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনার কথা ভেবেছেন? এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অশিক্ষিত মানুষেরও বেকারত্ব ঘুচবে! ‘প্রধান হরতাল প্রকৌশলী’, ‘সহকারী পিকেটার’ বা ‘অতিরিক্ত বোমাবাজ’ হয়ে তারা দেশের সেবা করতে পারবে। তা ছাড়া হরতাল তো আরব্য রজনীর রূপকথার কর্মসূচি না যে এটি পালিত হবে আর গাড়ি ভাঙা হবে না! সৃষ্টির সেরা জীব লাঠালাঠিতে ঠ্যাং না ভাঙলে বা বোমাবাজিতে দুই-চারটা না মরলে কি হরতাল জমে? কাজেই হরতালনির্ভর ইকোনমিক সিস্টেমে ইটপাটকেল, বোমা বা কাফনের কাপড় ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে সোনালি সম্ভাবনা!জ্ঞানপাপীরা বলেন, হরতাল দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়! কিন্তু আমরা যদি গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই হরতালময় করি, তাহলে এ সমস্যা আর থাকে না। তখন পড়ালেখার বিষয় হবে ‘মিছিল ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘পাল্টা ধাওয়া টেকনোলজি’, ‘টায়ার বার্নিং সায়েন্স’ ইত্যাদি। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে গবেষণার কোনো ক্ষেত্র না থাকলেও এই টপিকগুলোর জন্য এখানে রয়েছে গবেষণার পাকা ময়দান! এসব বিষয়ে যেহেতু অযোগ্যতাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা, তাই পরিত্যক্ত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো এই লাইনে হতে পারে দিশারি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের কোপাকুপি-গোলাগুলির ঘটনা থুতু মারার মতো বিষয় হলেও হরতালময় সমাজে এসব কর্মকাণ্ড পরিণত হবে শিল্পে! কে কত সুন্দর করে কোপাতে পারে, কত নিখুঁতভাবে রগ কাটতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যাবে প্রতিযোগিতা!এমন সমাজের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও লাগবে হরতালের উষ্ণ ছোঁয়া। ‘যে জন নিশিতে মনের খুশিতে পোড়ায় গাড়ির টায়ার’ জাতীয় কবিতা লেখা হবে। ‘পাথর সভ্যতা বনাম হরতাল সভ্যতা’ টাইপের গবেষণাগ্রন্থ বাজারে আসবে। খেলাধুলায় সূচিত হবে বৈচিত্র্য—শুরু হবে ‘উল্টা দৌড়’, ‘গাড়ি ভাঙচুর’ প্রতিযোগিতা। হরতালের সময় কালো ধোঁয়া নির্গমন বন্ধ হওয়ায় পরিবেশ, জানমাল রক্ষায়ও এর রয়েছে অতুলনীয় অবদান!আসুন, এসব বিবেচনা করে হরতালময় একটি দেশের দাবিতে সোচ্চার হই! যেহেতু সরকার ‘ইস্যু’ উৎ পাদন প্রক্রিয়া বন্ধ করছে না, অন্যদিকে আলোচনার পথ বন্ধ রেখেছে বিরোধী দল, সেহেতু মনের সুখ ফিরিয়ে আনতে হরতালময় রাষ্ট্রের বিকল্প নেই!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১১, ২০১১
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১১, ২০১১
No comments:
Post a Comment